হিন্দু ধর্ম মতে মৃতদেহ সৎকার:
মৃত্যুর সময় করনীয়ঃ—
কোন ব্যক্তির মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে ঐ ব্যক্তিকে প্রান ত্যগের স্থান থেকে সরানো যাবে না। শান্ত ও স্থিরভাবে প্রানত্যগ করবে। মৃত্যুর সময় কানে কোন পৌরানিক নাম প্রদান, টানা হেচড়া করা, বুকের উপর কোন ধর্ম বই রাখা, চিত্কার করা, ঢোল, করতাল বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো, নোংরা বিছানায় রাখা, কপালে বা শরীরে তিলক মাখানো কর্তব্য নহে। মৃত্যুর পর মৃত শরীরকে যত্নের সাথে একটি পরিস্কার স্থানে উত্তর দিকে মাথা ও দক্ষিন দিকে পদদ্বয় রেখে শুদ্ধ বিছানায় চিত করে শোয়াতে হবে। দুই চোখ, মুখ খোলা থাকলে বন্ধ করে দিতে হয়। দুই কান এবং দুই নাকের ছিদ্র তুলার সঙ্গে কর্পুর মিশিয়ে গুজে দিতে হয়। মৃত পুরুষকে পুরুষগন শুদ্ধ জলে স্নান করতে হয়। এবং মৃত মহিলাকে মহিলাগন স্নান করতে হয়। শুদ্ধ জলে নিম পাতা অথবা কুলপাতা মিশিয়ে জল ফুটিয়ে নিয়ে সেই জল কুসুম কুসুম গরম হলে সেই জল দ্বারা মৃতকের শরীর সাবান সহযোগে স্নান করাতে হয়। স্নান শেষে নতুন পরিস্কার বস্ত্র পড়াতে হয়। শশ্মানে নেয়ার আগে পরিবারের সবাই মৃত ব্যক্তির নিকট দাড়াবে এবং ঈশ্বরের উদ্দ্যেশ্যে প্রার্থনা করে বেদ মন্ত্রের শান্তি পাঠে করতে হয় এবং শান্তভাবে পবিত্র বেদের গায়ত্রী মন্ত্র অর্থসহ পড়তে পড়তে নীরবে মৃতকসহ চিতা এলাকায় যেতে হয়।
গ্রহনযোগ্য নয়ঃ—
শশ্মানে নেয়ার সময় ঢোল বাজানো, লম্ফ-ঝম্প, নিশান পোতা, খই বা পয়সা ছড়ানো, চিত্কার করা মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। চিতা এলাকায় বিড়ি, সিগারেট, গাজা, ভাং, মদ্যপান, মাদক গ্রহন, চিত্কার, কোলাহল, জোরেশোরে গান বাজনো করা যাবে না এটা কখনো গ্রহনযোগ্য নয়।
প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিঃ—
বেল, আম, ডুমুর, তেতুঁল, শমী, পলাশ প্রভৃতি মোটা শুকনা কাঠ যা মৃত ব্যক্তির ওজনের অন্তত ৭গুন। বেশিও দেয়া যেতে পারে। এছাড়া হোমযজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যথা দুটি মাটির কলসি, একটি কোদাল, একটি কুড়াল, একটি দা, একটি প্রদীপ এবং সত্কার্যে চিতায় অগ্নি প্রবেশ করানোর জন্য পলতা, কর্পুর এবং পাঁচ থেকে পনের কেজি পর্যন্ত ধুপ বা ধুনা।
চিতায় অগ্নি প্রদান মুখাগ্নি করার সময় নিম্নোক্ত বেদ মন্ত্র পাঠ করা হয়-
"ওঁ কৃত্বা দুস্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্যজানতা মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নবং পঞ্চত্বমাগতম।
দহেযং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্চতু।।"
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার আত্মার কল্যাণ কামনায় "দিব্যান্ লোকান্ স গচ্চতু" বলা উচিৎ।
প্রজ্জ্বলনের আগে মৃতদেহকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে মুখাগ্নি করা হয়। কার্পাস তুলা অথবা নতুন কাপড় দ্বারা পলতা তৈরী করে অথবা মশাল তৈরী করে ঘি এবং কর্পুর মিশিয়ে ঘৃতের প্রদীপ হতে অগ্নি গ্রহন করে মৃত ব্যক্তির মাথায় নিম্নভাগ হতে পদদ্বয়ের নিম্নভাগে নিম্নের মন্ত্রে আহুতি প্রদান করবে। সন্তান না থাকলে স্ত্রী, ভাই, বোন, নিজের বংশের লোক, শ্বশুরের বংশের লোক অথবা অন্য আত্মীয় চিতায় অগ্নি প্রদান করতে পারবে। যে কোন ভাবে মৃত ব্যক্তির (স্বাভাবিক মূত্যু, আত্মহত্যা, জলেডোবা, আগুনেপোড়া, দুর্ঘটনায় মৃত) অবশ্যই দাহ্য কার্য বা সত্কার হয়। একমাত্র গর্ভপাতকৃত সন্তান এবং ৩ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তানকে মাটিতে প্রথিত করতে হবে। এর পর বেদমন্ত্রে আহুতি দেয়া শুরু করতে হয়। সত্কার বা দাহকার্যে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিগন স্নান করে শুদ্ধবস্ত্র পরে প্রয়োজনে আচমন করে পবিত্র ভাবে দাহ কার্যে অংশগ্রহন করবেন। দাহকার্য শেষে যদি শরীরে ময়লা লাগে তবে স্নান করতে হয় তবে অবশ্যই অশৌচ হয়েছে মনে করে স্নান করা যাবেনা। প্রানত্যগের স্থানে স্বস্তিবাচন, শান্তিপ্রকরন এবং হোমযজ্ঞ করতে হয়। মুখে অগ্নি প্রদান, উলঙ্গ করে দাহ করা। প্রতি মৃত্যুবার্ষীকিতে হোমযজ্ঞ, ধর্মানুষ্ঠান, অনাথ আশ্রমে দান, বিদ্যালয় বা ধর্মচর্চা কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি করা যেতে পারে। সবসময় মনে রাখতে হবে যে মহাশত্রু হলেও মৃত ব্যক্তির সত্কারে সাহায্য করা উচিত।
সনাতন ধর্মে মৃতদেহ পোড়াবার তিনটি কারন আছে।
আধ্যাত্মিক কারণঃ
আমরা সনাতন ধর্মের অনুসারিরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। এই ত্রিতাপদগ্ধ সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহন করে মানুষ দুঃখজ্বালা ভোগ করুক এটা কেউ চাই না। যে দেহে তিনি এতদিন বাস করেছেন, তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন, পৃথিবীর যাবতীয় সুখের স্বাদ তাকে দিয়েছেন সে দেহের প্রতি আকর্ষণ ও মায়া থাকা স্বাভাবিক। দেহের প্রতি আকর্ষণে পুনঃ দেহ ধারনে তার আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে, ঐ আকাঙ্ক্ষা দূর করার উদ্দেশেই আকর্ষণের বস্তু দেহটিকে পোড়ানো হয়।
সামাজিক কারণঃ
আর্য ঋষিদের ভবিষ্যৎ চিন্তা এতে প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি হবে এবং এমন একদিন আসতে পারে যখন স্থানাভাব দেখা দেবে। মানুষের দেহ না পুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রেখে দিলে ক্রমশ মাটিতে রাখার জায়গার অভাব দেখা দিতে পারে। এই কারনেই দেহ পোড়াবার বাবস্থা।
বৈজ্ঞানিক কারণঃ
মানুষ বিভিন্ন কারনে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্য রোগে মৃত্যুই সর্বাধিক। এই সকল মৃতদেহে পচন ধরলে পরিবেশে বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব চিন্তা থেকেই আর্য ঋষিগণ শব পোড়াবার বিধি দিয়েছে।
মুখাগ্নি করার কারণঃ
আমরা সনাতন ধর্মের অনুসারি বিশ্বাস করি যে, মানুষ মৃত্যুর পর স্বর্গবাসী হয় অথ্যাৎ দেবলোকে যায়। কিন্তু, তিনি স্বর্গে বা দেবলোকে যাবেন কিভাবে? বৈদিক নিয়ম অনুসারে দেবলোকে বা স্বর্গলোকে পাঠাতে হলে দেবতাদের পুরোহিত অগ্নিতে আহুতি দিতে হয়। অগ্নিদেবই সে অর্চনা বা আহুতি দেবলোকে নিয়ে যান। তাই যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন তার প্রাণবায়ু অগ্নিদেবকে আহুতি না দিলে তিনি কি করে স্বর্গবাসী হবেন? প্রানবায়ু মুখ দিয়ে বের হয় বলে মুখে অগ্নি সংযোগ করে মন্ত্র পাঠ করতে হয়-
“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্য জানতা ।
মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্
ধর্মাধর্ম সমাযুক্তং লোভ মোহ সমাবৃতম্
দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু”
অনুবাদঃ তিনি জেনে বা না জেনে অনেক দুষ্কর্ম করে থাকতে পারেন। কালবশে মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। এ দেহ ধর্ম, অধর্ম, লোভ, মোহ প্রভিতি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। হে অগ্নিদেব, আপনি তার সকল দেহ দগ্ধ করে দিব্যলোকে নিয়ে যান। (ক্রিয়াকাণ্ড বারিধি)।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ
(সংগ্রহীত )
No comments:
Post a Comment