হিন্দুধর্মের আলো,এই ব্লগ সাইটটি হিন্দু (সনাতন) ধর্মের একটি পুর্নাঙ্গ ওয়েব পোর্টাল গড়ার প্রচেষ্টায় কাজ করছে। এই সাইটের মূল উদ্দেশ্য হলো হিন্দুধর্মের প্রচার। এই ব্লগ সাইটটি হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন মন্ত্র, বিভিন্ন পূজা-অর্চনা, আরতি, ধ্যান,দশবিধ সংস্কার, তিলক,আরাধনা,বিভিন্ন ব্রত পালনসহ বিস্তারিত জানতে পারবেন।এই সাইটি বড় তথ্যের ভান্ডার করতে কিছু পোস্ট ফেসবুক ও ব্লগ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে। এই ব্লগ পোস্ট সমূহ নিয়মিত শেয়ার করে হিন্দুধর্ম প্রচার বৃদ্ধিতে সাহায্য করবেন।

হিন্দু বিবাহের নিয়মাবলী

হিন্দু বিবাহের নিয়মাবলী:




“বিবাহ” শব্দটি বি-পূর্বক বহ্ ধাতু ও ঘঞ্ প্রত্যয়যোগে গঠিত। বহ্ধাতুর অর্থ বহন করা এবং “বি” উপসর্গের অর্থ বিশেষরুপে।সুতরাং বিবাহ শব্দের অর্থ বিষেশ রুপে বহন করা। বিবাহের ফলে পুরুষ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মানসম্ভ্রমরক্ষার সার্বিক ভার বহন করতে হয়।

স্মৃতি শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ মনুসংহিতায় আট প্রকার বিবাহের কথা বলা আছে।

সেগুলো হল:-

(১) ব্রাহ্ম
(২) আর্য
(৩) প্রাজাপত্য
(৪) আসুর
(৫) গান্ধর্ব
(৬) রাক্ষস
(৭) দৈব
(৮) পৈশাচ

জাতি এবং শ্রেণী বিভাগে এই বিবাহ গুলো হয়ে থাকে তবে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য বিবাহ রীতি গুলোই প্রচলিত।

বর্তমান মানব সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত এবং পালনীয়।
ব্রাহ্ম বিবাহ হল – কন্যাকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে এবং অলংকার দ্বারা আচ্ছাদন করে বিদ্বান ও সদাচারী বরকে স্বয়ং আমন্ত্রন করে যে কন্যা দান করা হয়তাকে ব্রাহ্মবিবাহ।

বর্তমানে কেউ না মানলেও সমাজে গান্ধর্ব বিবাহের প্রচলন আছে। নারী-পুরুষ পরস্পর শপথ করে মাল্যবিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে তার নাম গান্ধর্ব বিবাহ। এর উদাহরণ, মহাভারতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিবাহ গাদ্ধর্ব বিবাহ ছিল।

বেদে খুব পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছেঃ
উদীর্স্বাতো বিশ্বাবাসো নমসেলামহে ত্বা ।
অন্যামিচ্ছ প্রফর্ব্যং সং জায়াং পত্যা সৃজ ।।১০/৮৫/২২।।
—অর্থাত্ তুমি যাও ও অবিবাহিত নারীকে তোমার অর্ধাঙ্গিণী কর এবং তাকে সমান অধিকার প্রদান কর।

আমাদের সনাতন বিবাহে কত গুলো বিধিবিধান শাস্ত্রীয়, কিছু অনুষ্ঠান আচার রয়েছে। শুভলগ্নে নারায়ণ, অগ্নি, শিব, দূর্গা, গুরু ইত্যাদি দেবতাকে আহবান করে এবং পুরোহিত আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষী করে মঙ্গল মন্ত্রের উচ্চারণ, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বিয়ের মন্ত্রের শেষ হয় যজ্ঞের মাধ্যমে।

বিবাহের মূল মন্ত্র যা স্বামী স্ত্রীরা প্রতিজ্ঞা করে থাকে :
“যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।”
—তোমার এই হৃদয় আমার হোক আমার এইহৃদয় তোমার হোক।

বিবাহের মাধ্যমে একজন নারীপুরুষ চীর জীবন একসাথে সুখে দুঃখে থাকবার প্রতিজ্ঞা করে। বিবাহ আমাদের সনাতন ধমেঃর একটি অন্যতম অংশ। প্রত্যেকেরই জীবনকে পরিপূর্ণ করতে বিবাহ করা আবশ্যক।


বিবাহের কাল বিচার:
জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, সপ্ত বারের মধ্যে সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিবাহে প্রশস্ত। রবি, মঙ্গল ও শনি বারে বিবাহ হলে কন্যা কুলটা হয়। অমাবস্যা ও রিক্তায় (৪র্থী, ৯মী ও ১৪শী) বিবাহ অশুভ। তবে শনি বার রিক্তা তিথিতে বিবাহ শুভ। রেবতী, উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ, রোহিণী, মৃগশিরা, মূলা, অনুরাধা, মঘা, হস্তা ও স্বাতী এই সব নক্ষত্রসমূহে বিবাহ শুভ। ব্যতীপাত, পরিঘ, বৈধৃতি, অতিগ-, ব্যাঘাত, হর্ষণ, শূল, গ-, বিকুম্ভ এবং বজ্র যোগ ভিন্ন অন্নযোগে বিবাহ প্রশস্ত। শকুনি, চতুষ্পাদ, নাগ, কিন্তঘ্ন ও বিষ্টি করণে বিবাহ নিষিদ্ধ। বারটি মাসের মধ্যে মাঘ, ফাল্গুন, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও অগ্রহায়ণ মাসে বিবাহ প্রশস্ত। তবে অরক্ষণীয়া কন্যার নক্ষত্রে পৌষ ও মাঘ মাসেও বিবাহ প্রশসত্ম। লগ্নের ক্ষেত্রে কন্যা, তুলা, মিথুন ও ধনু লগ্নের পূর্বাংশে বিবাহ শুভ। বিবাহের সময় লগ্ন, ৫ম, ৯ম ও ১০মে বৃহস্পতি থাকলে সুতহিবুক যোগ হয়। গর্গমুনির মতে জন্মদিনে কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ তবে জন্ম-মাসে বিবাহ প্রশস্ত। জন্মদিনের পর আট দিন পরিত্যাগ করে কন্যার বিবাহের বিধান আছে। কন্যার ক্ষেত্রে জন্মবার, জন্ম-নক্ষত্র ও জন্ম-রাশিতেও বিবাহ প্রশস্ত। জ্যৈষ্ঠ ও অগ্রহায়ণ মাসে জ্যেষ্ঠ পুত্র বা কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের দশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর বিবাহ প্রশস্ত। জন্মদিন, জন্ম-বার, জন্ম-মাস, জন্ম-নক্ষত্র ও জন্ম-রাশিতে পুরুষের বিবাহ নিষিদ্ধ। সুতহিবুক যোগে লগ্নের গ্রহসংস্থান জনিত সকল দোষ নাশ হয়। এখন গোধুলি লগ্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। যে সময় শুভ লগ্ন থাকে না আবার বিবাহ-কার্যও আবশ্যক হয়ে পড়ে তখন গোধুলি লগ্নে বিবাহ প্রশস্ত। গোধুলি লগ্নে বিবাহে বার, তিথি, নক্ষত্র, বিষ্টিভদ্রা প্রভৃতি দোষ থাকলেও বিবাহ অশুভ হয় না। বিবাহের প্রশস্ত মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ ও মাঘ মাসে এবং শনি ও বৃহস্পতি বার গোধুলি লগ্নে বিবাহ নিষিদ্ধ।



পাটিপত্র:
বাঙালি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।

দধি মঙ্গল:
বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্য্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিড়ে ও দৈ খাওয়ানো হয়।

গায়ে হলুদ:
সংস্কৃত ভাষায় এই রীতিকে বলা হয় গাত্রহরিদ্রা। হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়। যেমন শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদি। প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ কন্যার বাড়ী পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো হয়।

শঙ্খ কঙ্কন:
কন্যাকে শাঁখা পরানো হয়।
এরপর বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।

বর বরণ:
বর বিবাহ করতে এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষ। সাধাবনত: কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান দুর্ব্ব ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। এরপর বরকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয় ।

সাত পাক:
বিবাহের মণ্ন্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়। সাধারণত: কন্যার জামাইবাবুরা পিঁড়ি ধরে থাকেন। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়।

শুভদৃষ্টি:
বিবাহের মন্ডপে জনসমক্ষে বর ও কন্যা একে অপরের দিকে চেয়ে দেখন।

মালা বদল:
কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। মুসলমান মতে একই ভাবে কন্যাকে বলতে হয় “কবুল”। আবার ঠিক এই রকমই খৃষ্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সন্মতি জানান।

সম্প্রদান:
কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরন পোষনের দ্বায়িত্ব নিলেন। বিবাহের মন্ত্র হল ” যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।”

অঞ্জলি:
কন্যা ও বর খৈ অগ্নাহুতি দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খৈ পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম।

সিঁদুর দান:
বিবাহের শেষ রীতি হল বর কন্যার কপালে সিঁদুর লেপন করেন। বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন।
বি:দ্র: এলাকার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে।
Share:

No comments:

Post a Comment

Powered By Blogger

Categories

লেখক

সুমন চন্দ্র বর্মন (সাগর)
অনার্স, এম এ (ইতিহাস)
টাংগাইল, ঢাকা, বাংলাদেশ।