হিন্দুধর্মে অন্নপ্রাশন বিধি:
অন্নপ্রাশন কি?
হিন্দুধর্মীয সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ উৎসব। দশবিধ শুদ্ধিজনক সংস্কারের অন্যতম একটি হচ্ছে অন্নপ্রাশন। অন্নপ্রাশন হল হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় প্রথা। অন্নের প্রাশন বা ভোজনকে অন্নপ্রাশন বলে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। ‘অন্ন’ শব্দের সাধারণ অর্থ যে-কোনো খাবার, বিশেষ অর্থ ভাত; আর ‘প্রাশন’ শব্দের অর্থ খাওয়া। তাই শিশুর প্রথম ভাত খাওয়া অনুষ্ঠানকেই বলা হয় অন্নপ্রাশন।
আক্ষরিক ভাবে এর অর্থ হল ‘প্রথম ভাত খাওয়া শুরু করা‘,এর মধ্য দিয়ে একটি শিশুকে শুধুমাত্র তরল খাদ্য থেকে কঠিণ খাদ্য দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। অন্যভাবে এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘মুখে ভাত’। মানে হচ্ছে আপনার শিশুর জীবনে মায়ের দুধের পর প্রথম শক্ত খাবারের যাত্রা শুরু। অর্থাৎ এই অনুষ্ঠানের পর থেকে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি শক্ত খাবার দেওয়া শুরু হয়। সাধারণত বাঙালীদের মধ্যেই এই অনুষ্ঠানের প্রচলিত রয়েছে এবং দেশের বেশিরভাগ অংশেই কিছুটা ব্যতিক্রমীভাবে হলেও এই অনুষ্ঠানটি করা হয়ে থাকে।সনাতন ধর্মে বলা হয়, শিশুর দাঁত উঠার আগেই অন্নপ্রাশন করা উচিত।
এই অনুষ্ঠানের পরবর্তীকাল থেকে বাচ্চাদের বুকের দুধ ছাড়িয়ে তাদের শুধুমাত্র শক্ত খাদ্য গ্রহণ অভ্যাস করানো শুরু করা হয়।
কি ধরনের খাবার সাধারণত শিশুকে দেওয়া হয়?
শিশুর প্রথম শক্ত খাবার হিসাবে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়াতে চাইলে ক্ষীর বা পায়েসই দেওয়া হয়ে থাকে। অথবা সাদা ভাত একটু ঘি দিয়ে নরম করে তারপর দেয় অনেকেই। অনেকে আবার এর সঙ্গে বিশেষভাবে রান্না করা ডালও যোগ করে থাকেন। তবে মজার বিষয় হলো, শিশুর সামনে সাধারণত মাছ, মাংস, নিরামিষসহ সব ধরনের খাবারই অল্প অল্প করে সুন্দর করে পৃথক বাটিতে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু খাওয়ানো হয় সামান্যই। পরে সেই খাবার অন্যদের মধ্যে পরিবেশন করা হয়।
অন্নপ্রাশন করার সময়ঃ
এদিন সাধারণত শিশুর মামা তাকে প্রথম খাইয়ে দেন। অন্নপ্রাশনের জন্য ছেলেশিশুর ৬ বা ৮ মাস এবং মেয়েশিশুর ৭ বা ৯ মাস বয়সকে উপযোগী মনে করা হয়। এ সময় শিশুর নামকরণও করা হয়। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। সেখানে আত্মীয়-স্বজনরা নিমন্ত্রিত হয় এবং শিশুর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনাপূর্বক শিশুকে উপহারসহ আশীর্বাদ করে। এ অনুষ্ঠান ঘরেও হতে পারে, কিংবা কোনো মন্দির বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও হতে পারে। সম্পূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশে এ অনুষ্ঠান করার শাস্ত্রীয় বিধান থাকলেও ইদানীং তা অনেকটা শিথিল হয়েছে; তবে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব এখনও অটুট রয়েছে।
কিভাবে হয় এই অন্নপ্রাশন?
বাবা-মা বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা এজন্য একটি শুভ দিনক্ষণ ঠিক করেন। বাচ্চাকে নতুন কাপড় পরানো হয়। সাধারণত শিশুর স্বাস্থ্য, কল্যাণ আর সমৃদ্ধি কামনা করে শুরুতেই ধর্মীয় কিছু আচার-আচরণ পালন করতে হয়। এরপরেই তার মুখে ভাত তুলে দেওয়া হয়। পরিবারের উপরই নির্ভর করে কে এই ভাত তুলে দেবেন। মূলত এই অনুষ্ঠানটি হচ্ছে শিশুর জন্মের পর একটি পরিবারে নিকটজনদের পুনর্মিলনী।
ধর্মীয় বিভিন্ন আচারের মধ্যে একটি হচ্ছে, কলা পাতা বা কাঁসার বড় থালায় করে কলম, খাতা, টাকা, অলংকার, মাটি, ধান জাতীয় বেশকিছু জিনিস রেখে দেওয়া হয় এবং শিশুটির সামনে তা তুলে ধরা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, শিশুটি হাত বাড়িয়ে যে জিনিসটা ধরবে, অর্থাৎ সে যে জিনিসটার প্রতি আকৃষ্ট হবে, বড় হয়ে সে সেটাই হবে। যেমন, কোন শিশু যদি কলম-খাতা ধরে তবে বলা হয় সে বড় হয়ে লেখাপড়া জানা মানুষ হবে, বিদ্বান হবে। আবার সে যদি টাকায় হাত দেয়, তার মানে সে ব্যবসায়ী জাতীয় কিছু হবে। মাটি ধরলে জমিবাড়ির মালিক হবে। ধান ধরলে কৃষিকাজে মনোযোগী হবে। মনে রাখতে হবে, এগুলো সবই ধর্মীয় বিধান থেকে উদ্ভুত ধারণা, বাস্তবের সাথে মিল হয়তো কমই পাওয়া যাবে।
এই অনুষ্ঠানটি কোথায় হয়ে থাকে?
সাধারণত নিজ বাড়ি অথবা নানা/দাদার বাড়িতে অন্নপ্রাশনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রচলিত আছে, মামাকেই প্রথম ভাত তুলে দিতে হয় বোনের সন্তানের মুখে। অনুষ্ঠানটির সঙ্গে ধর্মীয় কিছু বিষয় জড়িত বলে যারা এর আচার বিষয়ে জানেন, তাদের ডেকে নেওয়াই ভাল।
অন্নপ্রাশণ অনুষ্ঠানটি কেন পালন করা হয়?
অন্নপ্রাশণ অনুষ্ঠানটি শিশুর বৃদ্ধির পরবর্তী ধাপকে সূচিত করে।যদি বৈদিক যুগে ফিরে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে অন্নপ্রাশণ অনূষ্ঠানটি তখন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া, ইরান,এমনকি পারস্যের মানুষজনেরাও পালন করতেন।অভিভাবকদের সংস্কৃতি এবং তাদের বাসস্থানের ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে এই অনুষ্ঠানটি শিশুদের পাঁচ থেকে নয় মাস বয়সের মধ্যে কোন না কোন সময়ে পালন করা যেতে পারে। ঐতিহ্য অনুযায়ী সাধারণত চার মাসের কম বা এক বছরের বেশি বয়সের শিশুদের অন্নপ্রাশণ করা হয় না।এই অনুষ্ঠনের গুরুত্ব এতই বেশি যে সকল আত্মীয় স্বজনরা আমন্ত্রিত হন,যেখানে একটি বড় জায়গায় বিরাট ভোজের আয়োজন করা হয় এবং অনুষ্ঠানটির জন্য একটা শুভক্ষণ বেছে নিয়ে পুরোহিতরা উপস্থিত থেকে অন্নপ্রাশণের মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।
অন্নপ্রাশন বা মুখে ভাত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কিছু টিপস:
* অনুষ্ঠানের আগে আপনার এবং আপনার শিশুর পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন।
* সকালে স্নান বা গোসলের পর এবং দিনের বেলায় ঘুমের মাঝখানের সময়টাতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।
* শিশু যাতে বেশি পরিমাণে উত্তেজিত না হয়ে পড়ে সেজন্য অনুষ্ঠানটি যথাসম্ভব পরিবারের খুব কাছের মানুষজনের মধ্যে সীমিত রাখা।
* শিশুকে কি কাপড় পরাচ্ছেন সেটি বিশেষভাবে জরুরি। পোশাক যেন বেশি ঝলমলে না হয়, অর্থাৎ জরি বা গ্লাস সেট করা বা ভারী অ্যাম্ব্রয়ডারি করা কোন কাপড় শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
* শিশুকে খাওয়াচ্ছেন যিনি তার হাতটা পরিস্কার রাখা খুব জরুরি।
* শিশুর খাবার যেন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বজায় রেখে রান্না করা হয়। মনে রাখবেন, প্রথম খাবারেই যদি কোনরকম উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে, তাহলে অনেকদিন হয়তো এ নিয়ে আপনাদের ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই সম্ভব হলে অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেই প্রথম রান্নাটি করুন। এতে একধরনের মানসিক প্রশান্তিও আপনি অনুভব করবেন।
* শিশুকে খাওয়ানোর পর তার মুখের চারপাশে লেগে থাকা খাবার মুছে দেওয়ার জন্য একটি ছোট্ট টাওয়েল সাথে রাখুন।
* একজন ছাড়া যদি আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের কেউ শিশুকে খাওয়াতে চান তবে লক্ষ্য রাখুন তার হাত পরিস্কার কিনা, আর তা যেন নামমাত্র খাবার হয়।
* এই অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র শিশুর জীবনেই না, তার বাবা-মায়ের জন্যও খুব আনন্দের। কাজেই সামর্থ্য থাকলে একটা নতুন কাপড় এই অছিলায় নিয়ে নিন না। মন ভাল লাগবে।
* তাছাড়া, অনুষ্ঠানে যারা আসছেন তাদের জন্য ছোট্ট কোন উপহারের ব্যবস্থা আপনি রাখতে পারেন। এতে অতিথিরাও খুশি হবেন।
* সবচেয়ে বড় কথা, শিশুর জন্মের পর এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান স্মৃতিতে ধরে রাখার বিকল্প নেই। কাজেই ছবি তুলে বা ভিডিও করে তা রেখে দিন যত্নের সাথে। আপনার শিশুর সারাজীবনের আনন্দের সঙ্গী হয়ে থাকবে এই অনুষ্ঠানটি, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
No comments:
Post a Comment