হিন্দুধর্মের আলো,এই ব্লগ সাইটটি হিন্দু (সনাতন) ধর্মের একটি পুর্নাঙ্গ ওয়েব পোর্টাল গড়ার প্রচেষ্টায় কাজ করছে। এই সাইটের মূল উদ্দেশ্য হলো হিন্দুধর্মের প্রচার। এই ব্লগ সাইটটি হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন মন্ত্র, বিভিন্ন পূজা-অর্চনা, আরতি, ধ্যান,দশবিধ সংস্কার, তিলক,আরাধনা,বিভিন্ন ব্রত পালনসহ বিস্তারিত জানতে পারবেন।এই সাইটি বড় তথ্যের ভান্ডার করতে কিছু পোস্ট ফেসবুক ও ব্লগ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে। এই ব্লগ পোস্ট সমূহ নিয়মিত শেয়ার করে হিন্দুধর্ম প্রচার বৃদ্ধিতে সাহায্য করবেন।

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র অর্থ ও ব্যাখা

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র অর্থঃ


হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি ৩টি শব্দ দ্বারা গঠিত। শব্দ ৩টি হচ্ছে যথাক্রমে (১) হরে , (২) কৃষ্ণ ও (৩) রাম।

১.হরে শব্দটি সংস্কৃত "হরা" শব্দ থেকে এসেছে যা দ্বারা শ্রীমতি রাধারাণীকে সম্বোধন করা হয় । রাধারাণী ভগবানের পরম আনন্দময়ী শক্তি । সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর ভগবান তার নিজের সেবা ও ভক্তসঙ্গ লাভের জন্য শ্রীমতি রাধারাণীকে তার হৃদয়ের বামপাশ থেকে সৃষ্টি করেছেন । কাজেই রাধারাণীর অনুমতি ব্যাতীত কোন মানুষ এমনকি দেবতারাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারে না ।

২. কৃষ্ণ শব্দ দ্বারা সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণকে অর্থাৎ পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বুঝায় । তিনিই সর্বপ্রথম এবং সর্বাদিরূপ । তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন , তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি ।

৩. রাম শব্দ দ্বারা সর্ব আনন্দদায়ক শ্রীমান "বলরামকে" বুঝায় । বলরাম বৃন্দাবনে সবার অন্তরে আনন্দ সঞ্চার করেন । বলরামকে আমরা ভগবানের লীলা অবতাররূপেও দেখতে পাই ।

'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্রের সঠিক অর্থ হচ্ছেঃ
হে সর্বাকর্ষক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, হে সর্বানন্দদায়ক ভগবান শ্রীবলরাম, আপনারা আমাকে কৃপাপূর্বক আপনাদের চিন্ময় জগতের (Chinmoy Plannet) প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত করুন ।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।

'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর রুপী। কিন্ত নামকীর্ত্তন বা জপ করতে যেয়ে আমরা পাই মাত্র তিনটি নাম 'হরে', 'কৃষ্ণ' ও 'রাম'। পরমকরুনাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোলোকপতি সচ্চিদানন্দ অর্থাৎ সৎ, চিৎ ও আনন্দ রুপী ত্রিগুণের অধিকারী। এই ত্রিগুণ হলো সন্ধিনী, সংবিৎ ও হ্লাদিনী বা কর্ম, ঞ্জান ও ভক্তি রুপী। এই ত্রিগুণের অন্তর্গত হরে, কৃষ্ণ ও রাম নামেই অন্তর্নিহিত।

১ হরে - চন্দ্রাবলী,

২ কৃষ্ণ - শ্রীগোবিন্দ,

৩ হরে - প্রেমময়ী শ্রীরাধা,

৪ কৃষ্ণ - বাসুদেব,

৫ কৃষ্ণ - জগন্নাথ,

৬ কৃষ্ণ - বলভদ্র,

৭ হরে - সুভাসিনী,

৮ হরে - সিংহাসন,

৯ হরে - সুদর্শন,

১০ রাম - শ্রীরাধিকা,

১১ হরে - শেষদেব,

১২ রাম - লক্ষ্মী,

১৩ রাম - সরস্বতী,

১৪ রাম - সুভদ্রা,

১৫ হরে - সাবিত্রী এবং

১৬ হরে - রেবতী।

'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্রের বত্রিশ অক্ষরের তাৎপর্যঃ

০১) ‘হ’- অক্ষরে শ্রীললিতা সখী মস্তকেতে!

০২) ‘রে’- অক্ষরে শ্রীবিশাখা দক্ষিণ বাহুতে!!

০৩) ‘কৃ’- অক্ষরে চম্পকলতা সখীকন্ঠে রয়!

০৪) ‘ষ্ণ’- অক্ষরে চিত্রা সখী বাহুতে শোভয়!!

০৫) ‘হ’- অক্ষরে রঙ্গদেবী সখী থাকে হাতে!

০৬) ‘রে’- অক্ষরে সুদেবী যে থাকয়ে পৃষ্ঠেতে!!

০৭) ‘কৃ’- অক্ষরে তুঙ্গবিদ্যা বদন উপরে!

০৮) ‘ষ্ণ’- অক্ষরে ইন্দুরেখা শ্রবণ বিবরে!!

০৯) 'কৃ’- অক্ষরে শশীরেখা রহে ভুরুযুগে!

১০) ‘ষ্ণ’- অক্ষরে বিমলা সখী ভ্রুর ডান ভাগে!!

১১) ‘কৃ’- অক্ষরে পালিকা সখী ভ্রুর বামে রয়!

১২) ‘ষ্ণ’- অক্ষরে লবঙ্গমঞ্জরী থাকয়ে হৃদয়!!

১৩) ‘হ’- অক্ষরে শ্যামলা সখী নাভীতে থাকয়!

১৪) ‘রে’- অক্ষরে মধুমতী নাভি মধ্যে রয়!!

১৫) ‘হ’- অক্ষরে ধন্যা সখী করাঙ্গুলি রয়!

১৬) ‘রে’- অক্ষরে মঙ্গলা কর অধোমুখী হয়!!

১৭) ‘হ’- অক্ষরে শ্রীদাম সখা জঙ্ঘায় থাকয়!

১৮) ‘রে’- অক্ষরে সুদাম সখা জানু নিবসয়!!

১৯) ‘রা’- অক্ষরে বসুদাম সখা থাকে ভুরু অঙ্গে!

২০) ‘ম’- অক্ষরে অর্জুন সখা সদা থাকে লিঙ্গে!!

২১) ‘হ’- অক্ষরে সুবল সখা দক্ষিণ পদেতে!

২২) ‘রে’- অক্ষরে কিঙ্কিণী সখা আছয়ে বামেতে!!

২৩) ‘রা’- অক্ষরে চাতক সখা পূর্বে নিবসয়!

২৪) ‘ম’- অক্ষরে মধুমঙ্গল অগ্নিকোণে রয়!!

২৫) ‘রা’- অক্ষরে শুক সখা থাকয়ে দক্ষিণে!!।

২৬) ‘ম’- অক্ষরে বিশাল সখা রয় নৈঋত কোণে!!

২৭) ‘রা’- অক্ষরে মহাবল সখা পশ্চিমে থাকয়!

২৮) ‘ম’- অক্ষরে বৃষভ সখা বায়ুকোণে রয়!!

২৯) 'হ’- অক্ষরে দেবপ্রস্থ সখা উত্তরেতে!

৩০) ‘রে’- অক্ষরে উদ্ভব সখা আছে ঈশানেতে!

৩১) 'হ’- অক্ষরে মহাবাহু ঊর্ধ্বে রয় সুখে!

৩২) 'রে’- অক্ষরে ঈশান সখা আছে অধোমুখে!!

'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র সম্পর্কে  বিষ্ণু পুরাণে (৬/২/১৭) আরো বলা হয়েছে,
 “এই কলিযুগে ধ্যান, যজ্ঞ বা মন্দিরে অর্চনার কোন প্রয়োজন নেই ৷ কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে— কীর্ত্তন করার ফলে পূর্ণ আত্মোপলব্ধি অর্জন করা যায় ৷”

কাশীর মায়াবাদী সন্ন্যসী প্রকাশানন্দ সরস্বতী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে প্রশ্ন করেছিলেন— “সন্ন্যাসী হয়ে বেদ বেদান্ত অধ্যায় চর্চা বাদ দিয়ে কেবল 'হরে কৃষ্ণ' কীর্ত্তণ করে ভাবুকের মতো হীন কর্ম কর কেন? ”

উত্তরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন—
মূর্খ তুমি, তোমার নাহি বেদান্তাধিকার ৷
কৃষ্ণমন্ত্র জপ সদা এই মন্ত্র সার ৷৷
কৃষ্ণমন্ত্র হৈতে হবে সংসার মোচন ৷
কৃষ্ণ নাম হৈতে পাবে কৃষ্ণের চরণ ৷৷    (চৈ:চ:আ: ৭/৭২-৭৩)

কলিযুগে ভগবানের নাম হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্ত্তণই একমাত্র ধর্ম ৷
নাম বিনা কলিকালে নাহি আর ধর্ম ৷
সর্বমন্ত্র সার নাম, এই শাস্ত্র মর্ম ৷৷   (চৈ:চ: ১/৭/৭৪)

সকল শাস্ত্রের মূল কথা হল কেবল ভক্তিভরে
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্ত্তণ করা ৷


'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্রের অন্যতম ব্যাখাঃ 
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
এই মন্ত্রে আটবার হরে, চারবার রাম নাম বলা হয়েছে – তার উদ্দেশ্য কি?
হরি শব্দের অর্থ হরণ, কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কর্ষণ ও রাম শব্দের অর্থ রমণ।
 আটবার ‘হরে’ এই নামের দ্বারা ভক্ত কা’কে হরণ করবার জন্য শ্রীভগবানকে আহ্বান করেন?
ভূমিরাপোহনলো বায়ু খং মনো বুদ্ধি রেবচ।
 অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্নাঃ প্রকৃতিরষ্টধা ।। ৪
–শ্রীগীতা ৭ অঃ।

–ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মনঃ, বুদ্ধি, অহঙ্কার এই অষ্টপ্রকারে বিভক্তা শ্রীভগবানের অপরা প্রকৃতি এই আটটীকে হরণ করবার নিমিত্ত মহামন্ত্রে আটবার এই নাম বলা হয়েছে। পৃথিবীর পাঁচটি তত্ত্ব – শোণিত, মাংস, নাড়ী, ত্বক এবং রোম। জলের পাঁচটী তত্ত্ব – শোণিত, লালা, মূত্র, স্বেদ ও শুক্র। তেজের পাঁচটী তত্ত্ব – ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আলস্য, নিদ্রা ও এবং ক্লান্তি। বায়ুর পাঁচটী তত্ত্ব – চলন, বলন, ধাবন, প্রসারণ ও আকুঞ্চন। আকাশের পাঁচ তত্ত্ব – কাম, ক্রোধ, শোক, মোহ ও ভয়। মনের বৃত্তি – সংকল্প বিকল্প।
বুদ্ধির বৃত্তি – নিশ্চয়।
অহঙ্কারের বৃত্তি – অহং কর্ত্তা এই অভিমান। এই ভূমি প্রভৃতি আটটি অপরা প্রকৃতির বহির্মুখতা হরণ করবার জন্যই আটবার ‘হরে’ পদটী মহামন্ত্রে বলা হয়েছে, আট প্রকার প্রকৃতিই মহামন্ত্র জপের দ্বারা ভগবন্মুখী হয়।
চার বার কৃষ্ণ পদের দ্বারা কাদের কর্ষণ অর্থাৎ আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে। মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার এরা অন্তরিন্দ্রিয় মাত্র। বহির্মুখতা হরণ করলে কার্য্য সিদ্ধি হবেনা, তজ্জন্য এদের কর্ষণও প্রয়োজন। মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার শব্দের দ্বারা চিত্তকেও গ্রহণ করা হয়েছে। ‘রসো বৈ সঃ’ আনন্দময় তাঁর রসতম স্বরূপে মনকে আকর্ষণ করলে মন রসতমের সঙ্কল্প বিকল্পই করবে। বুদ্ধি তাঁকেই নিশ্চয় করে স্থির হয়ে যাবে। অহঙ্কার – আমি কর্ত্তা এই অভিমান ত্যাগ করত – ‘আমি রসময়ের দাস’ এই অভিমান করতে থাকবে, চিত্ত নিয়ত আনন্দময়ের অনুসন্ধানে নিরত হবে। মনোবুদ্ধি চিত্ত ও অহঙ্কারকে আকর্ষণ করবার জন্য মহামন্ত্রে চারবার কৃষ্ণ নাম কথিত হয়েছে।
আর চিরবাঞ্ছিত চারিটী স্থানে রমণ করবেন বলে ভক্ত চারবার রামকে আহ্বান করেন।
জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় এই চার অবস্থাতেই আনন্দময় লীলা করবেন বলে মহামন্ত্রের দ্বারা ভক্ত প্রাণারাম রামকে আহ্বান করে থাকেন – হে প্রিয়তম! তুমি আমার জাগ্রতে স্বপ্নে সুষুপ্তি ও তুরীয়ে রমণ কর। তুমি ভিন্ন যেন কোন অবস্থাতেই আমার আর কোন কিছু গ্রহণীয় না থাকে। তোমার রসে রসিত হয়ে আমি যেন সকল সময় থাক্‌তে পারি। হে রসতম! আমায় অমৃতময় রসময় মধুময় কর।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

Share:

No comments:

Post a Comment

Powered By Blogger

Categories

লেখক

সুমন চন্দ্র বর্মন (সাগর)
অনার্স, এম এ (ইতিহাস)
টাংগাইল, ঢাকা, বাংলাদেশ।