বর্ণপ্রথার প্রভাবে বিবাহ থেকে শুরু করে হিন্দুধর্মের চরম অবনতি
হিন্দু সমাজে চারটি বর্ণ প্রচলিত আছে। যেমন-১) ব্রাহ্মণ, ২) ক্ষত্রিয়, ৩) বৈশ্য ও ৪) শূদ্র।
আমরা মনে করি যে, একজন ব্রাহ্মণের পুত্রই ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়ের পুত্রই ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের পুত্রই বৈশ্য, শূদ্রের পুত্রই শূদ্র। আসলে ঘটনাটি সঠিক নয়।
বিবাহ ক্ষেত্রে বৈষম্যঃ
সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে এখনও বর্ণ প্রথা প্রবল।এদেশে এখনও ব্রাহ্মণের ছেলের বিয়ের জন্য ব্রাহ্মণ মেয়ে, দত্ত ছেলের জন্য দত্ত মেয়ে, কর্মকারের ছেলের বিয়ের জন্য কর্মকারের মেয়ে লাগবেই। কারণ অন্য জাতের মেয়ে হলে নাকি আবার জাতকূল ধুয়ে এক হয়ে যায়।এমনই অনেক হিন্দু পরিবার আছে,যেখানে অভিভাবকরা তাদের ছেলেদের/মেয়েদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে দিতে পারছে না শুধুমাত্র একই বর্ণের সুযোগ্য ছেলে/মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না বলে। দুঃখের কথা কি বলব, অনেকে বিয়ে করতে পারছেনা সুযোগ্য ভালো মেয়ে পাওয়া সত্যেও।তার কারন হচ্ছে জাতের সাথে জাতের মিল হচ্ছে না।তাহলে আপনারাই বুঝোন এই জাত প্রথাটা কতটা ভাইরাস হিসাবে এখনো আমাদের সমাজে যুগের পর যুগ টিকে আছে।বর্ণ প্রথার প্রভাব সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে কেমন তার সম্পর্কে আশা করি কিছু হলেও ধারনা পেলেন।
বর্ণঃ
প্রকৃত যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বোঝাতে তা হলো ‘বর্ণ’ (‘জাতি’ নয়)।‘বর্ণ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এই চারকে বোঝাতেই নয়, বরং দস্যু ও আর্যদেরকেও।
‘বর্ণ’ অর্থ হচ্ছে তাহাই যাহা গ্রহণ করা হয় পছন্দের দ্বারা। তাই, যেখানে ‘জাতি’ ঈশ্বর দ্বারা প্রদত্ত, ‘বর্ণ’ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব পছন্দগত।
যারা আর্য হতে পছন্দ করে তাদের বলা হয় ‘আর্য বর্ণ’। তেমনি যারা দস্যু হতে পছন্দ করে, তারা হয় ‘দস্যু বর্ণ’। একইভাবে হয় ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
এই সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ব্রাহ্মণ কি, ক্ষত্রিয় কি, বৈশ্য কি এবং শূদ্র কি ?
ব্রাহ্মণ :- ব্রহ্মজ্ঞানে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি সত্ত্বঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
ক্ষত্রিয় :- শাসক বা যোদ্ধা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
বৈশ্য :- ব্যবসায় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ ও তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
শূদ্র :- শ্রমজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন শূদ্র, যিনি তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা তপস্যা করেন, ক্ষত্রিয়রা শাসন ও যুদ্ধ করেন, বৈশ্যরা ব্যবসায় করেন এবং শূদ্ররা শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে । আমরা এর মাধ্যমে বুঝতে পারছি যে, যে যেরকম কর্ম করবে, সে সেই উল্লিখিত বর্ণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ একজন শূদ্রের পূত্র যদি ব্রহ্মজ্ঞানে দীক্ষিত হয় তাহলে সে ব্রাহ্মণ হবে এবং ঠিক এভাবেই একজন ব্রাহ্মণের পুত্র যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র হবে। এই যে বর্ণ বিভাজন-এটা কিন্তু জন্মভেদে নয় কর্মভেদে।
জাতি জন্ম নয় কর্মের উপর নির্ভর করে। যদি চিকিৎসকের ছেলে মেয়ে চিকিৎসার পড়াশোনা না করে তবে সে ডক্টর হবে না। সেইভাবে মা বাবার সন্তান বলে তার জাতি মা বাবার মতো হবে না। জাতি আপনার কর্মের ভিত্তিতে হয়। রামায়ণের রচয়িতা একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু তার পিতা শুদ্র ছিলেন। এগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, জাতি জন্মের ভিত্তিতে নয় কর্মের ভিত্তিতে হয়।
বেদে স্পষ্ট বলা আছে, যার যার কার্যকারণে তার বর্ণ নির্ধারণ করবে। এবং সকলেই সকলের উপর নির্ভরশীল। আসুন এবার দেখি সনাতন ধর্মে বর্ণ প্রথা সম্পর্কে ‘বেদ’ এ কি বলা আছে। ঋগবেদ
১.১১৩.৬
“একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে(ব্রাহ্মন) ,অপরজন বীরত্বের গৌরবে(ক্ষত্রিয়) , একজন তার নির্দিষ্ট পেশাভিত্তিক(বৈশ্য), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে(শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত। ঋগবেদ ৯.১১২.১
বৈদিক ইতিহাসে বর্ণ পরিবর্তনের অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন-
(ক)ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র কিন্তু তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া ব্রহ্ম এবং ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রহ্মকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ঋগবেদ বোঝার জন্য।
(খ)
ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯)
(গ)
সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজন ব্রাহ্মণ হন।
(ঘ)
প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন প্রায়ঃশ্চিত্তের পরে। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪)
যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?
(ঙ)
নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩
(ঙ)
নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩)
(চ)
ধৃষ্ট ছিলেন নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২)
(ছ)
তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন। (বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩)
(জ)
ভগবদ অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্ম নেন এক রাজার ঘরে।
(ঝ)
রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভগবদ অনুযায়ী।
(ঞ)
হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫)
(ট)
শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১)
এমনকি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।
(ঠ)
মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।
(ড)
রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ঢ)
প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ণ)
ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।
(ত)
বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
(থ)
বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।
বেদের কোথাও বলা নেই এক বর্ণের মানুষ আরেক বর্ণের পার্থক্য।কিন্তু উচ্চ বর্ণের মানুষরা নীচু বর্ণের মানুষদের মানুষ মনে করে কিনা সন্দেহ।
আশা করি বর্ণ প্রথা সম্পর্কে সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীদের আদি অন্ত পরিষ্কার করতে পেরেছি।আর এখনও যদি কেও ভাবেন সনাতন ধর্মে ব্রাহ্মনরাই উচুস্তরের তাহলে আপনাকে আমার আর বুঝানোর ক্ষমতা নাই।কারন ব্রাহ্মন সেই হওয়ার যোগ্য রাখে যে পাণ্ডিত দিক দিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।হোক সে বৈশ্য,ক্ষত্রিয় অথবা শূদ্র।বর্তমান সমাজে যেহেতু শিক্ষা ও পেশা সবার জন্য উন্মুক্ত তাই এ প্রথা আজ অপপ্রথায় পরিণত হয়েছে।বরং সমাজে বর্ণ ভেদের কারনে বিভাজন দৃশ্যমান, অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দারিয়েছে।
তবে আশার বিষয় হল এখন হিন্দু সমাজে অনেকটাই জেগে উঠেছে যার জন্য বিভিন্ন সময় এর চিত্রের মাধ্যমে প্রদর্শনী হয়, পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠান সংঘবদ্ধতার জন্য কাজ করছে।
এখন সমাজের প্রত্যেকটিই হিন্দুধর্মের যে কোনো ধর্মীয়গ্রন্থ পড়ার বা ধর্মীয়জ্ঞানের অধিকার রাখে।
আশা করি এর দ্বারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে হিন্দু সমাজ অচিরেই সংঘবদ্ধ হবে। প্রতিটি মানুষ ভগবানের কাছে সমান।
হিন্দুধর্মের সচেতনতা ও প্রচার বৃদ্ধিতে এই পোস্টটি শেয়ার করবেন।
সংগ্রহকৃত