উত্তর: হ্যাঁ,হিন্দুধর্মে এরকম উপাসনার বিধান আছে। প্রতিদিন তিনবেলা উপাসনা। হিন্দুধর্মে উপাসনাকে বলে 'ত্রিসন্ধ্যা'। এটি সূর্যের তিন অবস্থানের কালে করা হয়।
ত্রিসন্ধ্যা করার সময়:
প্রথম পদ/ সূর্যোদয় কাল — বিস্তার ২ মুহূর্ত (সূর্যোদয়ের আগের ৪৮ মিনিট + সূর্যোদয়ের পরের ৪৮ মিনিট)। নাম - প্রাতঃসন্ধ্যা।
অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ৪৮ মিনিট আগে থেকে সূর্যোদয়ের পরের ৪৮ মিনিট সময় পর্যন্ত হলো ১ম সন্ধ্যা।
দ্বিতীয় পদ/ মধ্যাহ্ন কাল — ২ মুহূর্ত সূর্য মাথার ওপর আসার আগের ৪৮ মিনিট + সূর্য মাথার উপর আসার পরের ৪৮ মিনিট)। নাম - মধ্যাহ্ন্যিক।
অর্থাৎ সূর্য মাথার উপর আসার ৪৮ মিনিট আগে থেকে সূর্য মাথার উপর আসার পরের ৪৮ মিনিট সময় পর্যন্ত হলো ২য় সন্ধ্যা।
তৃতীয় পদ/ সূর্যাস্ত কাল — ১ মুহূর্ত (সূর্যাস্তের পরের ৪৮ মিনিট)। নাম – সায়ং সন্ধ্যা।
অর্থাৎ সূর্য ডোবার পরে ৪৮ মিনিট সময় পর্যন্ত হলো ৩য় সন্ধ্যা।
(কাল অতীত হলে, অধিক অর্ঘ্য দান করতে হবে। কিন্তু এক বেলার সন্ধ্যা অন্য বেলায় বা তারও পরে করা যাবে না।)
ত্রিসন্ধ্যা কিভাবে এসেছে?
প্রথমে জানা যাক এই সন্ধ্যা বন্দনম্ আসলে কী?
বহুকাল আগে, সৃষ্টির প্রথমদিকে, সূর্যদেব দেখেন যে জগৎ সংসারের সমস্ত কিছুই অশুরের অন্ধকার করাল গ্রাসে চলে যাচ্ছে। এবং তিনি তার আলো এবং শক্তি দিয়ে সব রক্ষা করার চেষ্টা করতে শুরু করেন এবং ভগবান ব্রহ্মা কাছে সমাধান জানতে চান। তাতে প্রজাপতি ব্রহ্মা উত্তর দেন, “হে সূর্য নারায়ণ, তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রী বিষ্ণুর রূপ, তুমি নিয়ত তাদের এভাবে রক্ষা করে যাবে। এবং মানুষ, দেবতা সকলেই তোমাকে তিন বার অর্ঘ্য দানের মাধ্যমে শক্তি দিয়ে যাবে।”
সেই নিয়ম অনুযায়ী, আমরা কি ভগবান ব্রহ্মা নিজেও ত্রিসন্ধ্যা পালন করে থাকে। ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্তে এবং অন্য অনেক স্থানে এর উল্লেখ আছে।
ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়মঃ
১। সূর্যোদয়ের ৪৮ মিনিট আগে থেকে সূর্যোদয়ের পরে ৪৮ মিনিট সময় পর্যন্ত সময় করতে হয়।(একে বলে ব্রাহ্ম মুহুর্তে উঠা) ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা গুরু স্মরণ করে গুরু প্রদত্ত মন্ত্র এবং হরিনাম মহামন্ত্র জপ করবেন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।|
কমপক্ষে ১০৮ বার করে এবং যতবার খুশি জপ করবেন ও ঈশ্বরের স্মরণ ও মনন করবেন। এটা হল ১ম (সন্ধ্যা) বা প্রাতঃসন্ধ্যা। এটা সূর্য উঠার আধ ঘণ্টা পর পর্যন্ত চলতে পারে।তাঁর রূপকে চিন্তা করাকেই বলে ধ্যান।
২। এভাবে স্নানের পর দুপুরে অর্থাৎ সূর্য মাথার উপর আসার ৪৮ মিনিট আগে থেকে সূর্য মাথার উপর আসার পরের ৪৮ মিনিট পর্যন্ত সময়ে একইভাবে কমপক্ষে ১০৮ বার করে যতবার পারবেন জপ করবেন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।|
এভাবে ঈশ্বরের নাম করা ও তাঁর স্মরণ করা হল
২য় সন্ধ্যা বা মধ্যাহ্ন্যিক।
৩। এভাবে সূর্যাস্তের পর থেকে ৪৮ মিনিট সময় পর্যন্ত ৩য় সন্ধ্যা বা সায়ং সন্ধ্যা করতে হয়। অর্থাৎ সন্ধ্যা আরতির সময় করা বেশী উত্তম।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।|
একই ভাবে ১০৮ বা অধিক বার তাঁর নাম জপ ও তাঁকে স্মরণ করতে হবে। এটি হল ৩য় সন্ধ্যা।
এভাবে ত্রিসন্ধ্যা করা একান্ত কর্তব্য (এছাড়াও শোবার সময় উঠার সময় হাই তোলার সময়, হাঁচি, কাশিতে সর্বদা তাঁর নাম করতে হয়)। মনে রাখতে হবে ঈশ্বরকে মহিলা, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, শরীরের যে কোন অবস্থায় যে কোন কালে, যে কোন স্থানে এমনকি বাথরুমেও তাঁর নাম মনে মনে করবেন।
কারণঃ
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ৮/৫ শ্লোকে আছে-
অন্তকালে চ মামেব স্মরণ মুক্তা কলেবরম্
য়ঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং য়াতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ।।
অর্থাৎ মৃত্যুকালে বা দেহত্যাগকালে যে ঈশ্বরকে স্মরণ করে বা তাঁর নাম করে সে আমার ভাব অর্থাৎ ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হয় বা ঈশ্বর লাভ করে। মৃত্যু মানুষকে যে কোন সময় গ্রাস করে, বলে কয়ে আসে না। তাই যে কোন স্থানে দেহের যে কোন অবস্থায় মন্দিরে-শৌচালয়ে যে কোন স্থানে তাঁর নাম করা কর্তব্য।
তাই সর্বদা এমনকি শৌচ কালেও ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকা (জপ) স্মরণ (ধ্যান) করা যায়। সুতরাং যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা তার গুরু নির্ধারিত ইষ্ট মন্ত্র জপ করবেন। যাদের দীক্ষা হয়নি তবুও তারা ঈশ্বরের যে কোন নামে জপ করতে পারে।
সঙ্গে গায়ত্রী মন্ত্র জানা থাকলে সেটি পারলে জপ করা যায়।
গায়ত্রী মন্ত্রঃ
ওঁ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্ বরেণ্যং ভর্গদেবস্য
ধীমহি ধিয়ো ইয়েনঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।
গায়ত্রীর অর্থঃ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ অর্থ- স্বর্গ, মর্ত্য, অন্তরিক্ষ ব্রহ্মাণ্ড যাঁর থেকে উৎপন্ন হয়েছে সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার ধ্যান করি, আমাদের বুদ্ধি (মতি) পরমাত্মার দিকে পরিচালিত হউক।
সর্বদা জানবেনঃ পূজার চেয়ে নামজপ বা নাম করা বড় তাঁর চেয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করা আরো বড়। তাই জপ, ধ্যান অবশ্যই কর্তব্য। তবে বিশেষ দিনে পূজা করা কর্তব্য। জপ ধ্যান সর্বদা কর্তব্য।
তাছাড়াও শয়নকালে বা উঠার সময়, হাঁচি, কাশি, হাইতোলা যে কোন সময় যে কোন কর্মের শুরুতে ও শেষে তাঁর নাম করা কর্তব্য। যেমন- গা মোড়াবার সময় রাম রাম, হরিবোল, দুর্গা দুর্গা, হরে রাম হরে কৃষ্ণ ইত্যাদি। তাকে হরি ওঁ তৎ সৎ নামেও ডাকা যায়। আমাদের নিজ নিজ ব্যবসা ক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র ও যানবাহনে চলাচলে সর্বত্র বসে বসে বা হাটতে হাটতে ত্রিসন্ধ্যার সময় হলে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে পারি বা নাম করতে পারি।